লিকলিকে ছিপছিপে গড়নের কালো এক তরুন মুখে গোঁফের সরু রেখা, একদিনের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা না রাখা এক তরুণকে নামিয়ে দেওয়া হল বাংলাদেশ দলে ২০১৫ সালে ভারতীয় দলের বাংলাদেশ সফরের সময়। তৎকালীন এম এস ধনীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলে ছিল শেখর ধাওয়ান, রহিতশর্মা, আজিঙ্কে রাহানে, সুরেশ রায়না, রবিন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন এর মত খেলোয়ারা।
বর্তমান আধুনিক ক্রিকেটে যে দল যতই শক্তিশালী হোক না কেনো যেকোন সফরের সময় প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা সম্পর্কে যথেষ্ট হোম ওয়ার্ক করে নেয়। বাংলাদেশের তখন বলিং ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা , তাসকিন আহমেদ, রুবেল হোসেন, সাকিব আল হাসান, আরাফাত সানী, নাসির হোসেন। ভারতীয় দল নিঃসন্দেহে তাদের নিয়ে যথেষ্ট বিশ্লেষন করে এসেছে। কিন্তু মাঝে খান থেকে ঐ লিকলিকে গড়নের তরুন বাজিমাত করে দিয়েছে।
প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের ৩০৭ রানের জবাবে বেশ দারুন খেলছিল ভারত। দুই ওপেনার রহিত শর্মা ও শেখর ধাওয়ান তাদের সহযাত খেলা খেলছিল, এবং দারুন রান তুলে যাচ্ছিল। বাংলাদেশ প্রথম উইকেটের দেখা পায় ১৬ তম ওভারের শেষ বলে দলীয় ৯৫ রানে। ব্যক্তিগত ৩০ রানে তাসকিন আহমেদের বলে কট বিহাইন্ড হয়ে ফিরে যায় শেখর ধাওয়ান। মাঠে আসেন বিরাট কোহেলি ১৮ তম ওভারে তাসকিনের আবার আঘাত বিরাট কোহেলিকে ১ রান ও দলীয় ১০১ রানে ফিরিয়ে দেয়। আসে পরবর্তী ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাটিং এ আসেন আজিঙ্কে রাহানে।
মোস্তাফিজুর রহমানের প্রথম আঘাত হানে ২০.৫ ওভারে, কাটার রিড করতে ব্যার্থ হয় রহিত শর্মা ৬৩ রানে লিডিং এজে মিড অফে ক্যাচ দেয় মাশরাফি’র হাতে, দলীয় স্কোর ১০৫/৩। তৃতীয় উইকেট হারিয়ে পুরোপুরি ব্যাকফুটে ভারত। নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে আসেন সুরেশ রায়না। ২২ ওভারের শেষ বল মুস্তাফিজুরের স্লোয়ার কাটার বল রাহানে একটু আগে খেলতে গিয়েছিলেন মিস টাইমিং এ দারুন ফ্লায়িং ক্যাচ নাসির হোসেনের। রাহানে ফিরে গেলেন ব্যাক্তিগত ৯ এবং দলীয় ১১৫ রানে। ২৫০০০ দর্শকে পরিপূর্ণ স্টেডিয়াম একবারে উল্লাশে ফেটে পরেছে, বাংলাদেশ যে জয়ের দিকে আরো এক পা এগিয়ে গিয়েছে।
অধিনায়ক ধনি আসেন পরবর্তী ব্যাটসম্যান হিসেবে। সমস্যা ঘটে ২৫.২ ওভারে এম এস ধনি স্ট্রাইকে মোস্তাফিজুর বলিং এ ধনী সফট হ্যান্ডে পুশ করে দ্রুত সিঙ্গেল নেওয়ার জন্য দৌড় দেয় অভিষিক্ত মুস্তাফিজুর অবচেতন মনে ব্যাটসম্যানের রানিং লাইনে চলে আসে, এবং সরাসরি ধাক্কা ধনির সাথে। পুরা স্টেডিয়াম ফুঁসে ওঠে এই ঘটনায়। অভিষিক্ত মুস্তাফিজুর এর অবশ্যই ভুল ছিল ব্যাটসম্যানের লাইনে চলে আসা কিন্তু অভিজ্ঞ ধনী চাইলেই এই দূর্ঘটনা এরাতে পারত। (এই ঘটনায় পরবর্তীতে ধনীর ৭৫% এবং মুস্তাফিজুর রহমানের ৫০% ম্যাচ ফি কেটে নেওয়া হয়। মুস্তাফিজুর মেনে নিলেও ধনি প্রটেস্ট করেছিল যে তার ডান পাশে জায়গা ছিল না কারন ননস্ট্রাইকার ব্যাটহসম্যান দৌড়ে আসছিল এবং সে রানিং শুরুতে তার ব্যাট দুই হাতে ছিল এবং ধাক্কা এড়াতে ব্যাট একহাতে নিয়ে আসে।)
এর পরে আর মাঠে থাকতে পারেনি মুস্তাফিজ পরবর্তী ৪ টি বল নাসির হোসেন করে ওভারে শেষ করেন। ধনি বেশিক্ষন স্থায়ি হতে পারেননি ২৫.২ ওভারে সাকিব আল হাসানের বলে কট বিহাইন্ড হয়ে ফিরে যান দলীয় ১২৮ এবং ব্যক্তিগত ৫ রানে। জাদেজা পরবর্তীতে আসেন রায়নাকে সংঙ্গ দিতে এই দুই ব্যাটসম্যান দারুন খেলছিলেন। শুশ্রূষার পরে মাঠে ফিরে আসেন মোস্তাফিজুর, ওভারের প্রথম বলেই কাভারের উপর দিয়ে রায়নার ছয়, চতুর্থ বলে স্ট্রাইকে রায়না মুস্তাফিজুর ম্যাজিক দারুন এক কাটারে ইনসাইড এজ ক্লিন বোল্ড রায়না। মুস্তাফিজুর ৪০ রানে ফিরিয়ে দেয় রয়নাকে, পরবর্তী ব্যাটসম্যান আশ্বিন মাত্র এক বল স্থায়ি হতে পেরেছিলেন। স্লোয়ার কাটারে কট বিহাইন্ড মুশির গ্লভস বন্দি আশ্বিন। মুহূর্তেই স্কোর দাঁড়ায় ১৮৮/৭ জয় তখন সময়ের ব্যাপার।
কফিনে শেষ পেরেক টা ঠুকে দিলেন এই মুস্তাফিজ ৩৮.২ ওভারে স্বীকৃত শেষ ব্যাটসম্যান যাদেজার উইকেট তুলে নেয় মুস্তাফিজুর। আবারো কাটার লফটেট শট খেলে যাদেযা সৌম্য সরকারের হাতে মিড অনে তালু বন্দি হয়।
অভিষেক ম্যাচেই ৫ উইকেট নেবার কৃতত্ব অর্জন করে মু্স্তাফিজুর। আঘাত প্রাপ্ত হবার পর হয়ত তার মনে ভিন্ন কিছু কাজ করছিল, ফিরেই একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ার তিন ব্যাটসম্যানকে। বাংলাদেশ এই ম্যাচ জয় লাভ করে ৭৯ রানে।
পরবর্তীতে ম্যাচে মুস্তাফিজুর রহমান একাই নিয়ে নেয় ৬ উইকেট, বিনিময়ে খরচ করেন ৪৩ রান। এই ৬ উইকেটের তালিকায় ছিল রহিত শর্মা, এম এস ধনী, সুরেশ রায়না, রবীন্দ্র জাদেজা, অক্ষর প্যাটেল এবং রবীচন্দ্রর আশ্বিনের উইকেট। ভারতের ইনিংস গুটিয়ে যায় মাত্র ২০০ রানে এবং ঐ ম্যাচ বাংলাদেশ জিতে নেয় ৬ উইকেটে। এবং প্রথমবারের মত ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের গৌরব অর্জন করে। আজকের এই দিনে ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে এই কীর্তি গড়েন তিনি।
মুস্তাফিজুর রহমান ইতিহাসের দ্বিতীয় বলার হিসেবে প্রথম দুই ম্যাচে ৫ উইকেট নেবার কৃতিত্ব অর্জন করেন। এর আগে জিম্বাবুয়ের ব্রায়ান ভেটরি এই কীর্তি গড়েছিলেন। কিন্তু তিনি একমাত্র বলার যে প্রথম দুই ম্যাচে ১১ উইকেট তুলে নেন। এই সিরিজে তিনি আরো একটি ইতিহাস গড়েন কোন তিন ম্যাচের সিরিজে ১৩ উইকেট নেওয়া বলার হচ্ছেন একমাত্র তিনি।
মুস্তাফিজুর রহমানের টেষ্ট অভিষেক হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐ ম্যাচে তিনি ৪ উইকেট লাভ করেন এবং ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হন। এখন পর্যন্ত তিনি একমাত্র বলার যে ওডিআই এবং টেষ্ট অভিষেকে দুটোতেই ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছেন।
ভারতের ঐ সফরে এক মোস্তাফিজুর রহমানের কাছেই ভারত সিরিজ হেরে যায়। বাংলাদেশ গৌরব অর্জন করে প্রথমবার কোন দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ভারতকে হারনোর। বিশ্ব দেখতে পায় এক বিষ্ময় বালক তার একের পর এক কাটারে পর্যুদস্ত হয় ভারতের শক্ত ব্যাটিং লাইন আপ।