“টসে জিতলে ব্যাটিং নাও, মনে যদি সন্দেহ জাগে তাহলে চিন্তা কর আর ব্যাটিং নাও, তাও সন্দেহ দূর না হলে সতীর্থদের ডেকে আলোচনা কর এবং ব্যাটিং নাও!”
ক্রিকেট ফলো করেন কিন্ত এই উক্তিটি শোনেননি এমন মানুষ খুজে পাওয়া দুস্কর! এই বিখ্যাত উক্তিটি ক্রিকেটের আদি পিতা উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেসের। ব্যাট-বলের টুকটাক শব্দের যে সুরের মূর্ছনা ক্রিকেটে খুজে পাওয়া যায়, সেই ক্রিকেট নামক গিটারের একেকটা তার ছিলেন গ্রেস! তার উক্তিতেই বোঝা যায় ব্যাটিংয়ের প্রতি তার ভাললাগা!
পাড়ার ক্রিকেটে খেলার সময় প্রায়ই দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত সিনিয়রেরা ইনিংসের শুরুতেই আউট হয়ে গেলে মানতে চান না, শত চেষ্টা করেও মানাতে পারা যেত না তাদের। আধুনিক ক্রিকেটেও এমন একজন বড়ভাই ছিলেন, তিনি সেই গ্রেস! একবার হয়েছে কি, গ্রেস গিয়েছেন এক গ্রামে খেলতে! সেখানকার এক অখ্যাত বোলার একেবারে প্রথম বলে আউট করে দিল গ্রেসকে! সরাসরি বোল্ড! কিন্তু তিনি যে গ্রেস, এত সহজে হাল ছাড়বেন কেন? স্ট্যাম্পের বেল আবার জায়গামত বসিয়ে বোলারকে বললেন, “ট্রায়াল বলটা ভালোই করেছ । এবার আসল খেলা শুরু হোক, দেখি এবার আমাকে বোল্ড করতে পারো কিনা”! কথাটি বলেই আবারও উইকেটে গিয়ে দাড়ালেন তিনি ! কোনভাবেই তাকে সাজঘরে ফেরাতে রাজি করানো যায়নি।
সেই থেকে কতৃপক্ষ চালু করে ট্রায়াল বল।
মোটাসোটা আর বিশাল দেহের অধিকারী ছিলেন গ্রেস। আর খেলার মাঠে ঢিলেঢালা পোশাক পরিধান করতেন তিনি। একবার একটা বল ব্যাটে লেগে ঢুকে পড়লো তাঁর জামার ভেতরে। এই অবস্থায় রানের জন্য দৌড়াতে শুরু করলেন তিনি। সাত রান নেওয়ার পর প্রতিপক্ষের ফিল্ডাররা তাঁকে চেপে ধরে তাঁর জামার ভিতর থেকে বল বের করে আনলো। এই অদ্ভুতুড়ে ঘটনার পর থেকেই “ডেড বলের” নতুন নিয়ম চালু হয়।
খেলার মাঠে প্রচুর জেদি আর একরোখা ছিলেন তিনি। একবার এক ম্যাচে তাঁর দল ফিল্ডিং করছিলো। দিনের শেষ বলে ব্যাট মিস হয়ে বল লাগলো ব্যাটসম্যানের পায়ে। পরিষ্কার এলবিডব্লিউ। কিন্তু কেউ কোন আবেদন করলো না! আম্পায়ার দিনের খেলা শেষ ঘোষনার পরে ঐ ব্যাটসম্যান গ্রেসকে মজার ছলে বললেন,
“আপনারা কেউ আবেদন করলেন না কেন? আমি তো আউট ছিলাম।”
গ্রেস কিছু না বলে চুপ থাকলেন।পরেরদিন খেলা শুরু হবে, বোলার রান-আপ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন এমন সময় গ্রেস আম্পায়ারের সামনে আউটের আবেদন করে বসলেন!
“হাউ’জ দ্যাট?”
আম্পায়ারসহ মাঠের সবাই “থ” বনে গেলেন।
আম্পায়ার প্রশ্ন করতেই গ্রেসের নির্লীপ্ত উত্তর, “এটা ছিল আগের দিনের শেষ বলের আপিল!”
আম্পায়ারকে বাধ্য হয়ে আঙ্গুল উঁচু করতেই হল। কারণ কারণ আউট হওয়া বলের পরে আর কোন বল করা হয়নি!
প্রচন্ড রসিক মানুষ ছিলেন গ্রেস! রসিকতা করতে ছাড়তেন না কাউকেই! একবার একজন আম্পায়ার গ্রেসকে লেগ বিফোর আউট ঘোষনা করার পর সরাসরি আম্পায়ারের উদ্দেশ্যে বললেন, “এই যে এতো মানুষ খেলা দেখতে এসেছে, এরা কেউ কি তোমার আম্পায়ারিং দেখতেএসেছে? এরা এসেছে আমার ব্যাটিং দেখার জন্য।”
আউট হতে একেবারেই ইচ্ছে করত না গ্রেসের। আম্পায়াররাও বোধহয় তাঁর এই ইচ্ছেটাকে সম্মান করতেন অথবা বাধ্য হয়ে মেনে নিতেন। অবসর নেওয়ার কিছুদিন আগে এক ম্যাচে গ্রেসের বিপক্ষে একাধিকবার এলবিডব্লিউর আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলেন ফাস্ট বোলার চার্লস কোর্টনাইট।
শেষে রেগেমেগে গ্রেসের দুটো স্ট্যাম্পই একেবারে দিলেন উপড়ে। ফলাফল বোল্ড! এরপর গ্রেসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “ডাক্তার সাহেব, তুমি এবার নিশ্চয়ই মাঠ ছাড়বে?’ তখন আউট না হওয়ার কি যুক্তি দিলেন গ্রেস, জানেন? “দেখতেই পাচ্ছো একটা স্ট্যাম্প এখনো মাটিতে দাঁড়িয়েই আছে! তাছাড়া লোকে গাঁটের পয়সা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, নিশ্চয়ই তোমার বোলিং দেখতে নয়। আগে তিনটে স্ট্যাম্পই উপড়ে দেখাও, তারপর আউট করো!”
খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের প্রতি নির্দয় হওয়া গ্রেস ছিলেন মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! ক্রিকেটটা যেমন তার কাছে ছিল বৈচিত্র্যময়,তেমনি নিদারুণ এই ক্রিকেটটা তার কাছে ছিল একান্ত আপন, খুবই আন্তরিক। এখনকার সময়ের মত সেসময়ে দলের সাথে কোনো ফিজিও থাকত না। তাই ডাক্তার সাহেব সবসময় তার ডাক্তারি ব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে খেলতে যেতেন। কেউ আঘাত পেলে কিংবা অসুস্থ হলে তাতে সে যে দলেরই হোক না কেন তিনি নিজেই তার সেবায় নেমে পড়তেন মানবিক ভাবে।
ক্রিকেটের আদি ও প্রথম সুপার স্টার তিনি। সোজা কথায় আধুনিক ক্রিকেটের জনক। তাঁর ব্যাটিং এর দর্শকপ্রিয়তা ছিল চরম। প্রবাদ আছে গ্রেস খেললে টিকেট মূল্য ডবল হয়ে যেত। আজ থেকে ১৭২ বছর আগে ব্রিস্টলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ডব্লিউ জি গ্রেস ৮৭০ ম্যাচে রান করেছেন ৫৪,২১১! ইংল্যান্ডের হয়ে ২২ ম্যাচে করেছন ১০৯৮ রান। সবসময় ব্যাটিং করতে চাওয়া গ্রেস বোলার হিসেবে খেলতে পারতেন যেকোন দলেই।বল হাতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পেস বোলিং করে উইকেট নিয়েছেন ২৮০৯ টি, পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ২৪০ বার, ১০ উইকেট পেয়েছেন ম্যাচে ৬৪ বার। ফিল্ডা