“দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর,
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর,
জনশূন্য পল্লিপথে ধুলি উড়ে যায়,
যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়,
তবু চলে যায়!”
কবিগুরুর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সোনার তরী’র কিছু লাইনেই বোঝা যায় বিদায়ের ব্যাথা, বেদনা। আচ্ছা বিদায়ে এত বেদনা কেন? কেন এত কান্না, এত কষ্ট? এত হাহাকার? কেন?
বিদায় মানে কি তবে বিরহ? বিদায়ের অন্য অর্থ কি তবে বিচ্ছেদ? বিদায় মানে কি প্রিয় মানুষটিকে চিরতরে হারিয়ে ফেলা? বিদায়ের ক্ষণটি সে জন্যই কি ব্যথাভরা? সে জন্যই কি বিদায়বেলায় কারো ‘সজল করুণ নয়ন’ নত হয়ে থাকে বেদনায়? কিন্তু আমরা যে চাই হাসিমুখে বিদায় নিতে। কারো চোখের পানিতে বিদায়ের পথটি ভিজে কর্দমাক্ত হয়ে উঠুক, তা যে চাই না। সে জন্যই কি কবি নজরুল আকুতি করেছেন,
” আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়!
মোছ আঁখি, দুয়ার খোল, দাও বিদায়।”
সে জন্যই কি চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে বলি- ‘শুভ বিদায়’?
২০০৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর। চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে মুখোমুখি ভারত-বাংলাদেশ। ভারতীয় ইনিংসের ৪২তম ওভারের পঞ্চম বল, স্কোরবোর্ডে ভারতের রান দুই উইকেট হারিয়ে ১৮০ রান। নতুন ক্রিজে আসা অভিষিক্ত ধোনি বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের পায়ের উপরে করা বল ফ্লিক করে ফাইনলেগে ঠেলে সিঙ্গেলস নিতে চাইলেন। কিন্তু বিধিবাম! তাপস বৈশ্যর ছুঁড়ে দেওয়া বল ধরে স্টাম্প ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলট। ফলশ্রুতিতে রান আউটে কাটা পড়লেন তিনি। রান আউট হওয়ার আগে অভিষিক্ত মহেন্দ্র সিং ধোনি খেলতে পেরেছিলেন কেবল ওই একটি বলই!
১৯শে জুলাই, ২০১৯!
ওল্ড ট্রাফোর্ডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে এদিন নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি ভারত। ২৪০ রানের লক্ষমাত্রায় ব্যাটিং করা ভারতের সংগ্ৰহ তখন সাত উইকেটে ২১৫ রান। শেষ দশ বলে দরকার ২৫রান। ক্রিজে তখন সময়ের সেরা ফিনিশার ধোনি! ফার্গুসনের হালকা লাফিয়ে ওঠা বলকে গ্ল্যান্স করতে চেষ্টা করেন ধোনি, ব্যাটে-বলে ঠিকমতো না হওয়ায় শর্ট স্কয়ার লেগে বল চলে যাওয়ায় দুই রানের জন্য দৌড় শুরু করেন ৪৯ রানে অপরাজিত ধোনি, কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভেসে আসে,
” Push for two! Who is gonna cover the keepers stamps? They gonna go. They gonna get there. Oh! Direct hit! Gone…!”
মার্টিন গাপটিলের সরাসরি থ্রো ওই কিপার প্রান্তেই ইতি টানে ধোনির ইনিংসের, সঙ্গে ভারতের বিশ্বকাপেরও! কিন্ত সেটাই হয়ে রইল ধোনির শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ!
পাঁচ হাজার ৩১০ দিন আগে মিরপুরে যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে কিংবদন্তির জন্ম হয়েছিল, ওল্ড ট্রাফোর্ডে ঘটল সেই কিংবদন্তির যবনিকা পাত! শুরু আর শেষ, দুটিতেই মিশে আছে রান আউটের কাকতাল। প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি কিংবা অর্জন যদিও সবই ভিন্ন। এই দুই রান আউটের মাঝে ধোনির সাফল্যে রাঙা ক্যারিয়ার, ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্ক, চাঁছাছোলা কথা, অধিনায়কত্বের নয়া দর্শন, ক্রিকেট নিয়ে একেবারেই ভিন্ন পথে ভাবা নাকি একদম পুরো চরিত্র হিসেবেই তাকে ধরা। ধোনিকে নিয়ে আলাপ করতে গেলে কোনটাকে বড় করবেন, তা নিয়ে দোটানায় পড়বেন যে কেউ।
ব্যক্তিজীবনে বাইক চালাতে খুবই পছন্দ করেন ধোনী। অনেকে বলেন বাইক নাকি তার ‘সেকেন্ড লাভ’! উঁচু-নিচু রাস্তার আঁকাবাঁকা পথ যেভাবে সামলান বাইকে চড়ে তেমনি ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সিংহভাগ সময়ই সামলেছেন শক্ত হাতে! কখনো স্পিডব্রেকারের সামনে এসে স্লো করেছেন, কখনোবা ব্রেক কষেছেন। কিন্তু হার মানেন নি কখনো। কেনইবা হার মানবেন? তিনি যে অন্য ধাতু দিয়ে গড়া!
গত পনের বছরে মাঠে যেমন তড়িৎ গতিতে চমকে দেওয়া সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও সিদ্ধান্তগুলো একেবারে কম চমকপ্রদ নয়। অধিনায়কত্ব যেভাবে পেয়েছিলেন হটাৎ করে, ক্যাপ্টেন্সির বাটনও বারবার ছেড়েছেন হটাৎ করেই! ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিজের মাঝপথে হঠাৎ অধিনায়কত্বের অবসর ঘোষণা করলেন, কোনো বিদায়ী টেস্ট, বিদায়ী ভাষণ কিংবা বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনেরও সুযোগ দেননি! ভারতের টেস্ট ইতিহাসে এভাবে বিদায় বলেনি আর কেউ! ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় দলের সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণাটাও যথেষ্ট চমকপ্রদ। কেননা তাঁর নেতৃত্বেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ওয়ানডে ও তিন টি-টুয়েন্টি ম্যাচের সিরিজ খেলার কথা ছিল ভারতের। সেই সিরিজ শুরুর দিন দশেক আগে ধোনি বিসিসিআইকে জানিয়ে দিলেন, সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও আর অধিনায়কত্ব করবেন না!
গত বিশ্বকাপের পর থেকে নিজেকে একেবারেই আড়াল করে রেখেছিলেন ধোনি। তাঁর অবসর নিয়ে কত কথাই হলো এ সময়ে। গতকাল অবসর নিলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষবারের মতো মাঠে নেমেছিলেন ওই নিউজিল্যান্ডের সাথেই, সেটাই হয়ে রইল তার শেষ ম্যাচ! আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছিলেন রানআউটে, শেষটাও হলো রানআউট দিয়ে। শুরু আর শেষটা যেভাবে একবিন্দুতে মিলে গিয়েছিল, সেভাবেই বারবার নিজের ক্যারিয়ার রাঙিয়েছেন, মিলিয়েছেন