রাউন্ড দ্যা উইকেট থেকে তাইজুলের ঘূর্ণি না বুঝতে পারা হ্যাজেলউড বলের লাইন মিস করলেন, বল আঘাত হানে সরাসরি প্যাডে। তাইজুলের আবেদনে সাড়া দিতে একবিন্দু কালক্ষেপণ করেন নি নাইজেল লং। তিনি ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে যতক্ষণে জানান দিলেন এটা আউট, ততক্ষণে স্ট্যাম্প বগলদাবা করেছেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম! তাইজুল তো বটেই, সাকিব-তামিম-মুশফিকের গন্ডি পেরিয়ে, গ্যালারির দরজা ভেঙে উৎসবে মেতে উঠেছে পুরো বাংলাদেশ । এ জয় কারো একার না, এ জয় সবার, এ জয় পুরো বাংলার! নন-স্ট্রাইক প্রান্তে ৩৩রানে অপরাজিত বাংলাদেশের গলার কাঁটা প্যাট কামিন্স তখন বিপর্যস্ত। তবে সেদিন সবার চোখ-ক্যামেরার লেন্স আটকে যায় একটা বিন্দুতে । সবার আকর্ষণ নিমজ্জিত যে কেন্দ্রে, সবার দু চোখ খুঁজে ফেরে যে মহানায়কে তিনি সাকিব আল হাসান!
“Behind every successful man, there is a woman”
একজন সফল পুরুষের সফলতায় নাকি সবচেয়ে বড় অবদান একজন নারীর, এ কথা মানেন-বিশ্বাস করেন অনেকেই। সেদিনের পর থেকে এই প্রবাদে বিশ্বাস রাখি আমরাও। আমার ভাষায় বললে, “Behind every success of shakib, there is a shishir!”
একটু পিছনে ফেরা যাক-
তৃতীয় দিনের শেষ বিকেলে ২৬৫ রানের লক্ষে ব্যাটিং করা অস্ট্রেলিয়া মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে তুলে ফেলে ১০৯ রান । তৃতীয় দিনে শেষে অজিদের দরকার মাত্র ১৫৬ রান। হাতে আছে আটটি উইকেট! এখান থেকে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো যাবে ভেবেছিল কেউ?
ম্যান অব দ্য ম্যাচ সাকিব তো ভাবেননি। রাতে মুঠোফোনে স্ত্রী শিশিরকে বলেছিলেন, ” কঠিন হয়ে গেল, পারবো না হয়তো!”
‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ সাকিব না ভাবলেও তার স্ত্রী শিশির ভেবেছিলেন। সাকিবকে জবাবে বলেছিলেন,
” একমাত্র তুমিই পারো যে কিনা পারে বাংলাদেশকে জেতাতে!”
সাকিবকে যে বিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিলেন শিশির, সেই বীজ ফলে রূপান্তরিত হয় ম্যাচে দশ উইকেট আর প্রথম ইনিংসে ৮৪ রানের মাধ্যমে অজিদের দর্প চূর্ণ করে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে।
ঘটা করে সেদিন ঘরণীকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন তার ওপর বিশ্বাস রাখার জন্য। ম্যাচ জিতে মাঠ ছাড়ার পর সাকিব বলছিলেন, ‘জানি না আজ আমাদের ওপর কার বিশ্বাস ছিল। তবে ড্রিঙ্কসের সময় আমি সবাইকে বললাম, আজকে সবাই খেলা দেখতে এসেছে আমরা জিতব ভেবে। এই মানুষগুলোকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।’
বিশ্বাসের প্রসঙ্গ আসতেই ভেসে আসে মাইক্রোফোন হাতে দর্শকদের প্রতি সাকিবের কৃতজ্ঞতাবোধ,
“আপনারাই আমাদের দলের টুয়েলভ ম্যানের কাজ করেছেন, আমাদের উপর বিশ্বাস রাখার জন্য ধন্যবাদ!”
সাকিব আল হাসান একজন অতিমানব। ব্যক্তিজীবনে হয়তো না, কিন্তু বাইশ গজে কার্যত একজন সুপারম্যান! ক্রিকেট মাঠে যা চান, তাই নাকি করতে পারেন তিনি! বাইশ গজে অনেক মহাকাব্যিক উপাখ্যানের জন্ম দিয়েছেন তিনি! তিনি যে জাদুকর।
বাংলাদেশ দলে তাঁর টিমমেটদের প্রায় সবাইই জানেন সাকিবের এই অতিমানবীয় ক্ষমতা! তবে ক্ষমতার সবচেয়ে বড় ভক্ত অথবা এই মতবাদের প্রবক্তা সাকিবের প্রিয় বন্ধু তামিম ইকবাল। সেই অনূর্ধ্ব-১৫ দল থেকে দুজন একসঙ্গে খেলেছেন। সাকিবের নাড়ি-নক্ষত্র তাঁর চেনা। এক ছাদের নিচে দুজনে ছিলেন অনেকদিন! তারপরও সাকিবকে নিয়ে তাঁর বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। বরং ক্রমাগত তা যেন বেড়েই চলেছে। একবার তামিম প্রথম আলোকে বলেছিলেন,
“মিস্টার সাকিব আল হাসানের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে, মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশের হয়ে ও যা করে, তাতে ও নিজেই বিস্মিত হয় কি না?”
সাকিব হয়তো বিস্মিত হন না, কারন নিজের যোগ্যতায় যে ভরসা রাখেন তিনি। যেমনটা তার উপর ভরসা রাখে পুরো বাংলাদেশ!
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাকিবের এই যোগ্যতার বলির পাঠা হয়েছেন তামিম! এমনও হয়েছে, তামিম দারুন এক ইনিংস খেলেছেন, কিন্তু সাকিব ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত করে, সব রেকর্ড উলট পালট করে পার্শ্ব নায়ক বানিয়ে রেখেছেন তামিমকে! সে ম্যাচের কথাই ধরুন না, সেম্যাচেও প্রথম ইনিংসে দশ রানে তিন উইকেট পড়ার পর দুই বন্ধু মিলে গড়লেন ১৫৫ রানের জুটি, বন্ধু তামিমের ৭১ রানের পাশাপাশি সাকিব করলেন ৮৪! দ্বিতীয় ইনিংসে তামিম করলেন ৭৮। আর সাকিব?
– উভয় ইনিংসেই পাঁচ উইকেট করে নিয়ে লাইমলাইটের সকল আলো কেড়ে নিলেন সাকিব! সাকিবরা এমনই হন। তারা ফেইমের কাছে যান না, ফেইম তাদের কাছে আসে!
আগের তিন দিনে যে সাকিবকে দেখা গেছে, এদিন সেই সাকিব ছিলেন পুরোপুরি ভিন্ন! আগের দিনের থেকেও উজ্জীবিত। চোখে-মুখে জয়ের নেশা। এদিন সাকিব ছিলেন সেই সাকিব, যে দুর্দমনীয় সাকিব আমাদের বড্ড চেনা! স্মিথ-ওয়ার্নার অবিচল আছেন, অবিচ্ছিন্ন আছেন কিন্ত সাকিবের একটুও বিচলতা নেই। ওয়ার্নার সেঞ্চুরির আগে একবার মুশফিকের হাতে ক্যাচ দিলেন সাকিবের বলে, রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেলেন ওয়ার্নার। দলের সবাই যেখানে বিমূর্ষ সাকিব সেখানে তার লড়াকু মনোভাবে অবিচল।
ভাগ্য নাকি সবসময় সাহসীদের পক্ষে থাকে, এ কারণে হয়তো মাঝে মাঝে সাহসীদের পরীক্ষা নেয়া হয়, সাকিব এ পরীক্ষায় পাশ করলেন ওয়ার্নারকে এলবিডব্লিউ আর স্মিথকে কট বিহাইন্ডের ফাঁদে ফেলে! সেই শুরু, এরপর আউট করেছেন ম্যাক্সওয়েল আর ওয়েডকে! কখনো উইকেট নিয়ে তার সেই ট্রেডমার্ক তালি কিংবা দু হাত শূন্যে ভাসিয়ে সতীর্থদের আলিঙ্গন! সেদিন আমরা নতুন সাকিবকে চিনলাম, যে সাকিব দু হাত ছড়িয়ে পাখির মতো উড়ে! এই সেই পাখি যে নিজের বাঁহাতে ভর করে পাড়ি দেন দূর-বহুদূর! কিংবা ওয়েডকে আউট করে সেই জাদুকরী নাচের সেলিব্রেশন! যে জাদুকর কোনো বাঁধায় হারাননা, ভাঙেন তবু মচকান না! যে জাদুকর বিপদে নতজানু বসে না থেকে উঠে দাঁড়ান, লড়াই করেন! এর জন্যই বোধহয় শিরোনামহীন গেয়েছে,
“হারাইনি, খুন হয়েছি জাদুকর
ভেঙেছি, তবু নতজানু বসে নেই, জাদুকর
শূন্য করিডোরে পদচিহ্ন রেখে যাই
আগামীর বার্তা জানাই ….