“আমার ভাই ওয়াজির যে কিনা আমার টিমমেটও সে আমার পুরো শরীর অলিভ অয়েল দিয়ে মাসাজ করে দিয়েছিলো যাতে করে পরেরদিন আমার খেলতে সমস্যা না হয়। রেকর্ডের কথা শুনে আমি হেসে দিয়েছিলাম, কারন ভেবেছিলাম এটা ভাঙ্গা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আমার মা একপ্রকার আদেশই করলেন যাতে আমি রেকর্ডটা ভেঙ্গেই বাসায় ফিরি”
১১ জানুয়ারি, ১৯৫৯। পাকিস্তানের ঘরোয়া লীগ “কায়েদ-ই-আজম” এর সেমিফাইনালে মুখোমুখি করাচি ও ভাওয়ালপুর৷ মাত্র ১৮৫ রানে শেষ হয় ভাওয়ালপুরের প্রথম ইনিংস। করাচির ইনিংস শুরু করতে কিছুক্ষন পর ব্যাট হাতে নামেন পাকিস্তানের “লিটল মাস্টার” খ্যাত হানিফ মোহাম্মদ।
প্রথমদিনের খেলা শেষে হানিফ ২৫ রানে অপরাজিত ছিলেন। এরপর দ্বিতীয় দিনেও তিনি সারাদিন ব্যাট করে যান। দ্বিতীয় দিন শেষে করাচির স্কোর দাড়ায় ৩৮৩/৩। হানিফ অপরাজিত ছিলেন ২৫৫ রানে।
দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে হানিফ অনেক ক্লান্ত ছিলেন। তখনি তার বড় ভাই ও করাচির ক্যাপ্টেন এসে তাকে তৎকালীন ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেটের বিশ্ব রেকর্ড (ডন ব্র্যাডম্যানের ৪৫২ রান) ভাঙ্গার জন্য উৎসাহিত করেন। হানিফ প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দেন এটাকে অসম্ভব বলে। কিন্তু তার ভাই ওয়াজিরের তার প্রতি বিশ্বাস ছিলো। তিনি নিজেই হানিফের শরীর মাসাজ করে দেন এবং আর হানিফের মা হানিফকে রেকর্ড ভেঙ্গে আসার জন্য জোর করেন!
তৃতীয় দিনের খেলার কিছুক্ষন পরেই হানিফ তার ট্রিপল সেঞ্চুরি পেয়ে যান। তিনি ততক্ষণে অনেক টায়ার্ড। তবুও দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় তিনি ব্যাট করতে থাকেন। এমনি ছিলো তার মনসংযোগ যে পুরা ইনিংসে মাত্র ১ টি লফটেড শট খেলেন, তাও বোলারের মাথার উপর দিয়ে! একটা সময় হানিফ ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেন।
দিনের শেষ বলের আগের বলে হানিফ স্কোরের দিকে তাকালেন। সেখানে তার নামের পাশে রান লিখা ৪৯৬। তিনি ভাবলেন এই দুই বলেই ৫০০ নিয়ে ফেলতে হবে যাতে করাচি তাদের ইনিংস ঘোষনা করতে পারে। সেই বলটি পয়েন্টে ঠেলে দিয়েই তিনি দৌড় দিলেন। ফিল্ডার বল মিস করায় হানিফ ভাবলেন তিনি ২ রান নিয়ে ফেলতে পারবেন আর তাই সেই উদ্দেশ্যে স্ট্রাইকিং এন্ডে দৌড় দিলেন। কিন্তু, বিধিবাম! ফিল্ডার সেই বলটি আবার দ্রুত কালেক্ট করে থ্রো করে কিপারের কাছে, কিপার লাগায় স্ট্যাম্পে। হানিফ মোহাম্মদ অল্পের জন্য হয়ে গেলেন রান আউট!
যখন প্যাভিলিয়নে ফিরে আসছিলেন হানিফ আবার তাকালেন স্কোরবোর্ডের দিকে। তা দেখে তো তার চোখ ছানাবড়া! সেখানে তার নামের পাশে ৪৯৯ রান! প্রকৃতপক্ষে স্কোরার তার কাজে কিছুটা স্লো ছিলো৷ তাই হানিফের রান যখন ৪৯৮ সে তুলে রেখেছিলো ৪৯৬। বল ডেলিভারির আগে হানিফ তাই দেখেন, আর তার দেখার পরপরই স্কোরবোর্ড পরিবর্তন হয় যা তিনি আর খেয়াল করেননি। পরবর্তীতে হানিফ মোহাম্মদ বলেন “আমি যদি জানতাম আমি ৪৯৬ রানে না বরং ৪৯৮ রানে আছি তাহলে সেই দ্বিতীয় রানটি নেয়ার জন্য কখনোই এত তাড়াহুড়া করতাম না”! অবশ্য পরে স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যানের কাছ হতে তার রেকর্ড ভাঙ্গার জন্য শুভেচ্ছা বার্তা পেয়ে হানিফ তার ৫০০ রান না করার দুঃখ ভুলে যান।
পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে ব্রায়ান লারা ৫০১* করে হানিফের এই রেকর্ড ভেঙ্গে দেন আর ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র ৫০০ রান করা ব্যাটসম্যান হয়ে যান।
এই ইতিহাসের সাথে একটি দুঃখজনক ঘটনাও যুক্ত রয়েছে। হানিফ ৪৯৯ রানে রান আউট হওয়ার সময় তার ব্যাটিং পার্টনার ছিলেন আব্দুল আজিজ। তিনি ফাইনালে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করার সময় একটি বাউন্সার তার মাথায় লাগে এবং সেই আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখকঃ সাজ্জাদুল কাদের