একটা ছক্কা দূরে সাকিব!

0
4333

ক্রিকেটে ইনফর্ম আর অফফর্ম বিষয়টা শুধুই পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা যায় না সবসময়। আপনি যখন ফর্মে থাকবেন আপনার দুর্বলতার জায়গাও আপনার অন্যতম সফলতার জায়গায় পরিণত হবে। দেখা যাবে বোলারের করা উইকেট টেকিং ডেলিভারিকে আপনি অনায়াসে দারুণ এক শটে রূপ দিচ্ছেন বাউন্ডারিতে। দেখা যাবে বোলারের গুড লেংথে করা ইনসুইংগারকে আপনি ফ্লিক করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন মিড উইকেট দিয়ে সীমানায়, আবার অফ স্ট্যাম্পের সামান্য বাইরে পিচ করানো শর্ট অফ গুড লেংথ বলকে অনায়াসে স্কয়ার কাটে করছেন সীমানা ছাড়া। দ্যাটস অল এবাউট কনফিডেন্স এন্ড পজিটিভিটি! ইনফর্ম অবস্থায় আপনি যতটা কনফিডেন্ট থাকবেন অফফর্মে থাকা অবস্থায় আপনার কনফিডেন্স থাকবে ততটাই তলানিতে। ধরুন আপনি কভার ড্রাইভ খেলতে পছন্দ করেন, শুধু করেনই না ওটা আপনার অন্যতম প্রধান শক্তির জায়গা। আপনি কভার ড্রাইভ খেলার বল পাচ্ছেন, কিন্তু বোলারের হালকা আউট সুইংয়ে আপনি পরাস্ত হচ্ছেন। আবার বোলার আপনাকে জুসি হাফ ভলি দিচ্ছে, আপনি সজোরে হাঁকালেন কিন্তু বলের দিশা আপনি খুঁজে পেলেন ফিল্ডারের হাতে। এমনটা হয়, প্রায়ই হয়, সব ক্রিকেটারের জন্যই এটা অলিখিত সত্যি!

২০১৬ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়টাতে সাকিব আল হাসান ছিলেন আমার দেখা তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে অফফর্মে, আর তামিম ইকবাল ছিলেন ইনফর্ম। ওটা ছিল তামিমের ক্যারিয়ারের জন্য স্বর্ণযুগ, আর সাকিব আল হাসান তখন নিজের টাইমিং নিয়ে ধুঁকছেন, প্লেসমেন্ট নিয়ে ধুঁকছেন। ওমানের সঙ্গে ম্যাচ চলছে, বিশ্বকাপে তখন তৃতীয় ম্যাচ, সাকিবের বড় কোনো রান নেই। বলার মতো রান বলতে এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটা ৩৩! তামিম তখন সেঞ্চুরি থেকে অল্প কিছু রান দূরে, সাকিব ক্রিজে এসে দুটো বল ভালো টাইমিং করেও ভালো প্লেসমেন্টের অভাবে কোনো রান পাননি। অপর প্রান্ত থেকে তামিম ইকবাল ইশারা করছিলেন সিঙ্গেলসের জন্য। তখন কমেন্ট্রি বক্সে খুব সম্ভবত ছিলেন সুনীল গাভাস্কার। তিনি তখন এই অফফর্ম-ইনফর্ম নিয়ে যা বলেছিলেন তা ছিল আমার লেখার শুরুর সারাংশ।

সেদিন ওমানের সঙ্গে ম্যাচের প্রথম তিনবলেই ছিলেন রানশূন্য! চতুর্থ বলে মারেন প্রথম চার। ইনিংসশেষ করেন নয় বলে ১৭ রানের ক্যামিওতে। সেখানে ছিল মিড উইকেটের উপর দিয়ে মারা এক ছক্কা, যে ছক্কা ছিল তার জন্য হাফ ছেড়ে বাঁচার, সকল নার্ভাসনেস দূর করার! পরে সুপার টেনে অজিদের সঙ্গে করছেন ফিফটি। ভারতের সঙ্গে খেলেছেন আরেকটা ছোট্ট ক্যামিও।

একটা ছক্কার আবেদন আপনার আমার কাছে কতটা? অন্যসব সাধারণ ঘটনার সঙ্গে ছক্কা মারায় মুখের হাসি যতটা চওড়া হয় ঠিক ততটা, কিংবা ম্যাড়মেড়ে ম্যাচে হঠাৎ করে মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়া “ওয়াও”! আর একজন ক্রিকেটারের কাছে, বিশেষ করে সাকিবের কাছে হয়তো তখন সেই ছক্কাটা ছিল অন্য সবকিছু থেকেই আলাদা। সেই ছক্কাটা তখন ছিল সকল ট্রলের জবাব, হাসি তামাশার দাঁতে কপটাঘাত! সেই ছক্কার কনফিডেন্সেই হয়তো এক ম্যাচ পরে অজিদের বিপক্ষে ব্যাটে-বলে পারফর্ম করেন নবাব!

ক্রিকেট জীবনের অংশ, সাকিবদের কাছে ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ। হয়তো ক্রিকেটটাই সাকিবের কাছে জীবন, সাকিব ভক্তদের কাছেও সেটাই। ফর্মে ফিরতে যতটা সময় লাগে, তার সিকিভাগও লাগে না ফর্মের পতনে! ফর্মে থাকা খেলোয়াড় মুহূর্তেই সাক্ষী হতে পারেন অফফর্মের, আকাশে উড়তে থাকা বাজপাখির পতন ঘটতে পারে নিমিষেই! বিশ্ব ক্রিকেটে ছড়ি ঘোরানো সাকিব হটাৎ করেই এক সকালে সবাইকে শোনান সেই বেদনার কাব্য, যে বেদনার নীল বিষে আক্রান্ত হই আমরা সকলে! আর সাকিব? গাড় লাল চোখের পানি মুছতে মুছতে, এক চাপা কষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে হয়তো এক প্রতিজ্ঞা করেন। ব্যর্থতার গ্লানি মুছে এগিয়ে যাবেন এক সীমাহীন দক্ষতায়। যে ঘটনা সাকিবকে হারাতে পারত, সেই ঘটনা থেকে মুক্তি পেতে সাকিবের দরকার আর একটা ছক্কা। যে ছক্কা তাকে বারবার ফর্মে ফিরিয়েছে, সাহস জুগিয়েছে।

সাকিবের ইনিষ্পিরেশনের কথা মনে আছে? কার জন্য সাকিব খেলতে নামে মনে আছে?
-সেই বাচ্চা ফুল বিক্রেতা, যে কিনা সাকিবকে চেনে ‘ছক্কা সাকিব’ নামে, যে কিনা প্রবল ভালবাসার নিবেদনে ফুলের বিনিময়ে কোনো অর্থ নেয় নি প্রিয় সাকিবের থেকে। শুধু বিনিময়ে চাওয়া একটাই, সাকিব যেন প্রতি ম্যাচে মারে সেই ছক্কাই! সেই বাচ্চা ফুল বিক্রেতাও এখন হয়তো বড় হয়ে গেছে, সেদিন সাকিবের দেখা পেয়ে তার চোখ থেকে আনন্দের যে অশ্রু ঝড়েছিল, একবছর আগে সেই দুচোখে ঝড়েছিল কষ্টের বান। কষ্টের কান্না মুহূর্তেই পরিণত হতে পারে সুখের কান্নায়, সেজন্য সাকিবকে মারতে হবে আর একটা ছক্কা। পৃথিবীর করা দেড়শ কিলোমিটার গতির বাউন্সারে ডাক না করে, কাউন্টার অ্যাটাকে হুক করে স্কয়ার লেগের সীমানা ছাড়া করুক সাকিব। সেটাই চাওয়া থাকবে। যেন সেই ছক্কার সাথে সাথে পৃথিবীর আকাশে যে রঙধনুর দেখা মিলবে, সেখানের সাত রঙে লেখা থাকবে,
” সুপারম্যান ইস ব্যাক ইন হিজ স্টাইল!”