কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ

0
9042

” আমি কখনোই কোনো ব্যাটসম্যানকে আহত করতে চাইনি, তাদেরকে ভয় দেখানোই লক্ষ্য ছিলো আমার। ডনও (ব্র‍্যাডম্যান) আমার বোলিংয়ের সামনে ভীত হয়েছিলো। ”

ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার কে? শচিন টেন্ডুলকার? নাকি ডন ব্র‍্যাডম্যান? হয়তো শচিন নিজেও ভোট টা ব্র‍্যাডম্যানকেই দিবে। গোটা ক্রিকেট ক্যারিয়ারেই যিনি বোলারদের বেঢড়ক পিটিয়েছেন, তুড়িতেই বলকে সীমানার ওপার করতে পারতেন যিনি। রান যেনো তার কাছে ছিলো হাতের মোয়া। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসের হতাশা বাদে যার ক্যারিয়ারের পুরোটাই ছবির মতোন রঙিন, তিনি তো সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হবেনই।

” ১৯৩০ সালের ইংল্যান্ড সফর ”
এ্যাশেজ সিরিজে সেবার যেনো নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার ডন ব্র‍্যাডম্যান। ব্রিটিশ বোলারদের স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে ৫ টেস্টের ৭ ইনিংসে ব্যাট হাতে রান করলেন ৯৭৪, গড় ১৩৯.১৪। তার রান ছিলো এমন, ৮ ও ১৩১, ২৫৪ ও ১, ৩৩৪, ১৪, ২৩২। দুরন্ত ব্র‍্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়াও তাই সিরিজ জিতে নিয়েছিলো ২-১ ব্যবধানে। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক সিরিজে আর কেউই এতো রান করতে পারে নি। স্রেফ ওয়ালি হেমন্ডই ব্র‍্যাডম্যানের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সাদা পোশাকের এক সিরিজে ৯০০ র অধিক রান করেছেন। তবে ৯০৫ রান করতে ওয়ালিকেও খেলতে হয়েছিলো আরো দুই ইনিংস বেশী। ৯ ইনিংসে করেছিলেন ৯০৫ রান।

বছর খানেক পরের কথা, সালটা ১৯৩২। লন্ডনে এক আড্ডায় চার ভদ্রলোকের বিষয়বস্তু ছিলো কিভাবে এ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করা যায়। হ্যাঁ, স্রেফ এ্যাশেজ জয় নিয়েই যেনো গোল মিটিং। অজিদের হারাতেই হবে, থামাতে হবে দানবীয় ব্যাটসম্যান ডন ব্র‍্যাডম্যানকে।

ব্রিটিশ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন বুঝে নিয়েছিলেন, ডন কে থামাতে পারলেই এ্যাশেজের শিরোপা পুনরুদ্ধার করা যাবে। ফিরিয়ে আনা যাবে সেই সম্মান, যার ভাগিদার হবে শুধুই ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, কে থামাবে ডন ব্র‍্যাডম্যানকে, অদৌ তাকে থামানোর উপায় আছে কি? ডগলাস ব্র‍্যাডম্যানকে নিয়ে স্ট্যাডি করে যে ফল টা পেলেন তার সারমর্ম হচ্ছে, লেগ স্ট্যাম্পের উপর পিচ করে বডির দিকে দ্রুত আসা বলে যেনো কিঞ্চিৎ নড়বড়ে ডন ব্র‍্যাডম্যান। তবুও দুর্দান্ত পায়ের কারুকাজ, দ্রুতগতির জন্য তাও যেনো খাটে না ব্র‍্যাডম্যানের জন্য। এরপরেও তো বাজি ধরতেই হবে৷ তবে তার জন্য চাই প্রচন্ড গতির সাথে নিখুঁত নিশানা, একেবারে বোলারকে থাকতে হবে একশোতে একশো, ডনের মোকাবেলা করতে নিরানব্বই হলেও যেনো চলবেনা।

অবশেষে নতুন পরিকল্পনা আঁটলেন ডগলাস জার্ডিন, সেনাপতি হিসেবেই যেনো ডনকে ঘায়েল করার জন্য নিযুক্ত করলেন উদিয়মান হ্যারল্ড লারউডকে। যার ক্যারিয়ারের প্রথম ১৬ টেস্টে উইকেট ছিলো মাত্র ৪৫ টা। তবে ডগলাসের মাথায় ছিলো অন্য চিন্তা, লারউডের সাথে রণক্ষেত্রে নামালেন আরেক বোলার বিল ভোসকে। দুজনের মূল লক্ষ্যই ছিলো লেগ সাইডের দিকে ব্যাটসম্যানের শরীরকে স্ট্যাম্প হিসেবে ধরে একটানা শর্ট পিচ বল করে যাওয়া। লেগ সাইডে তখন ফিল্ডার রাখা হতো ৫/৬ জন। আবার এই দুই বোলারের টানা শর্ট পিচের বলগুলোও ছিলো ক্রিকেটারদের শরীর লক্ষ্য করে। তখনকার সময়ে ক্রিকেটারদের শরীরের উপরিভাগে বুকের গার্ড বা মাথায় হেলমেট পড়ার ততোটা প্রচলন ছিলো না।

ছবি: হেরল্ড লারউডের বলে মাথায় আঘাত প্রাপ্ত অস্ট্রেলীয়ার ব্রেট আউটফিল্ড।

ফলে ৯০ মাইল গতিবেগের উপরে ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে ছোড়া বলগুলো আগুনের গোলার ন্যায় ছিলো। মারাত্মক বাউন্সে ব্যাটসম্যানের জখম হওয়ার সম্ভাবনাও ছিলো বেশ। ইংলিশ মিডিয়া এটিকে ” ফার্স্ট লেগ থিওরি বোলিং ” নামে অভিহিত করলেও পরবর্তীতে এই অদ্ভুতদর্শন বোলিং আক্রমণের জন্য এই সিরিজ কুখ্যাতি পায় ” বডিলাইন সিরিজ। ” তাতে অবশ্য থোড়াই কেয়ার করেছিলেন ব্রিটিশ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন, কেননা নিয়মের ভিতর থেকে তিনি যা চেয়েছিলেন তা যে সুদে আসলে পেয়েছিলেন।

তো প্রথম টেস্টে লারউড কতটা সফল হলেন? অসুস্থতার জন্য সেই ম্যাচে একাদশের বাইরে ছিলেন ডন ব্র্যাডম্যান। তবে লারউড অসফল হন নি, অন্তত অজি ব্যাটসম্যানরা তার সামনে দাঁড়াতেই পারেন নি। ৫*২ = ১০ কিংবা দুই ইনিংসের ৫+৫ = ১০। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো একই ম্যাচে ১০ উইকেট প্রাপ্তি সাথে জার্ডিনের আরেক বাজির ঘোড়া বিল ভোসের ৬ উইকেট শিকার। পুনরুদ্ধারের মিশনে প্রথম ধাপে ইংল্যান্ডের জয় টা আসলো ১০ উইকেটে।

দ্বিতীয় টেস্টেই ফিরলেন ডন ব্র্যাডম্যান। কিন্তু এবারও লারউড কতটা সফল হবেন ব্র‍্যাডম্যানের বিপক্ষে তা জানা গেলোনা, আরেক তুরুপের তাস ভোসের প্রথম বলেই যে বোল্ড হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন ডন। তবে কি এবার ভাগ্যের চাকা ঘুরবে ব্রিটিশদের দিকে? পরের ইনিংসে অবশ্য ঠিকই অপরাজিত এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দলকে ১১১ রানের বড় ব্যবধানে জয় পাইয়ে দিলেন। আরো একবার যেনো বুঝিয়ে দিলেন, বাইশগজের ডন আমিই, চুনোপুঁটি তোমরা, রাঘব বোয়ালের সাথে লাগতে এসো না কেমন? ডনের বীরত্বে তাই সিরিজেও ১-১ এ সমতা আনলো অস্ট্রেলিয়া।

তবে আসল খেলা শুরু হলো তৃতীয় টেস্ট থেকে। অজিদের দুজন ব্যাটসম্যান লারউডের বোলিংয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলেন, যদিও তখন বডিলাইন অনুযায়ী বোলিং করেন নি তিনি। এরপরেও এই নিয়ে বিতর্ক চললো বেশ। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে এই নিয়ে চিঠি পাঠালো ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডের উদ্দ্যেশ্যে। যাতে অখেলোয়াড়সুলভ এই আচরণ বন্ধ করা হয়। তবে তা অগ্রাহ্য করলো ব্রিটিশরা। ফলে দুই দেশের মধ্যেই তিক্ততা বাড়তে লাগলো, এই নিয়েই চলতে থাকলো সেবারের এ্যাশেজ।

এরপরের ৩ টেস্টে ডনের রান দাঁড়ালো ৪ ও ৬৬, ৭৬ ও ২৪ এবং ৪৮ ও ৭১। আর আশ্চর্য বলতে ৪ বারই লারউডের বলেই আউট হলেন তিনি। সেই সিরিজে ৫৬.৬৭ গড়ে ৩৯৬ রান করলেও স্রেফ ডন ব্র‍্যাডম্যান বলেই এই পার্ফমেন্সও যথেষ্ট ছিলোনা। চারদিকে চলছিলো তুমুল আলোচনা, অন্যদিকে ইংলিশরাও সিরিজ জিতে নিলো ৪-১ ব্যবধানে।

ডগলাস জার্ডিনের টোটকাটা কাজে লাগলো বেশ।
সেই সিরিজে ৫ টেস্ট খেলে হ্যারল্ড লারউড শিকার করেছিলেন মোট ৩৩ টি উইকেট। এরপর নটিংহ্যাম্পশায়ারে সারের হয়ে এক ম্যাচ চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশ অধিনায়ক গ্যালারী ভর্তি দর্শকদের সামনেই স্বীকার করলেন সাবেক এই কয়লা শ্রমিকের জন্যই এ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে ইংল্যান্ড। ততোদিনে ব্রিটিশদের কাছে হিরো বনে গেলেন লারউড। তার মুখ থেকেই এই গল্প শোনার জন্য ভীড় জমাতে লাগলো পেপার থেকে টিভির সাংবাদিকরা। মাত্র এক সিরিজেই আকাশছোঁয়া উচ্চতায় পৌছে যাওয়া হ্যারল্ড লারউডের শেষটা কি এতো সুন্দর ছিলো?

কুখ্যাত “বডিলাইন” সিরিজের রেশ ধরে দুই দেশের মধ্যে প্রশাসনিকভাবেও অবস্থা খারাপ হতে চললো। ফলে সব ঠিক করতে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের উদ্দ্যেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ড চিঠি পাঠানোর মনস্থির করলেন, আর বলির পাঠা বানালেন সেই হ্যারল্ড লারউডকেই। কিন্তু স্রেফ অধিনায়কের কথামতোই সব করা লারউড সেই চিঠিতেই নিজের দস্তখত করেন নি, নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ডকেই “ঘরের শত্রু বিভিষণ” হতে দেখায় অবসর নিয়ে ফেললেন।

কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজই ছিলো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে হ্যারল্ড লারউডের শেষ ম্যাচ। নায়ক থেকে খলনায়ক কিংবা ঘরের শত্রু বিভিষণ। নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে যাওয়া লারউড পরবর্তীতে পাড়ি জমায় সেই অস্ট্রেলিয়াতেই। অজিরাও সাদরেই গ্রহণ করে নেয় কুখ্যাত এই বোলারকে।

পরবর্তীতে ডনের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ পেয়ে লারউড হয়তো ভেবেছিলেন,
” এ আমি কাদের বিপক্ষে লড়েছিলাম? ”

উৎসর্গঃ কাউকে কখনো লেখা উৎসর্গ করিনি, তবে জন্মদিনে “বার্থডে বয়” প্রিয় ওমর সাইফ ভাইকেই এই লেখাখানা উৎসর্গ করিলাম….. ?

লেখক: মুজাহিদুল ইসলাম জাহিদ