দুর্বল প্রতিপক্ষ পেলেই জ্বলে উঠেন তামিম?

0
3847

তামিম ইকবাল খান। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম একটি নাম। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। ১৩ বছর ধরে দলকে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন। নানা সময় সমালোচিতও হয়েছেন। ব্যাড প্যাচ এর সময় নানারকম কথাও শুনেছেন ক্রিকেটভক্তদের কাছ থেকে। স্বীকার হয়েছেন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আক্রমণের। এতসবের ভিড়ে নিজের অবস্থায় অটল ছিলেন সবসময়ই।

আজ আমরা তামিমের ১৩ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ওয়ানডে স্ট্যাটের দিকে একটু ম্যাগনিফাই করবো। কোথায় কোনসময়ে কার বিপক্ষে তামিমের ফর্ম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিরকম ছিলো তা বিশ্লেষণ করাই আজকের এই লেখার মূল লক্ষ্য।

শুরুতেই কোন দলের বিপক্ষে তামিমের স্ট্যাট কেমন তার দিকে আলোকপাত করা যাক। তামিম সবথেকে বেশি ম্যাচ খেলেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। অবশ্য পুরো বাংলাদেশ টিমের সবার স্ট্যাট বিশ্লেষণ করলে এটাই পাওয়া যাবে। কারণ বাংলাদেশ সবথেকে বেশি ম্যাচ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই খেলেছে এবং খেলে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তামিম ম্যাচ খেলেছে ৪১ টি। প্রায় ৪৩ এভারেজ আর ৮০ স্ট্রাইকরেটে ১৬৮৪ রান। সর্বোচ্চ ৩ টি সেঞ্চুরি ও সর্বোচ্চ ১৫৮ ব্যাক্তিগত সংগ্রহ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই। এরপর আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬ টি ম্যাচ খেলেছে তামিম ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে। প্রায় ৪১ গড় আর ৭৬ স্ট্রাইকরেটে ৯৩৩ রান। ২ টি সেঞ্চুরি আর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ১৩০* রান। এরপরই আছে ২৪ টি ম্যাচ খেলা প্রতিপক্ষ শ্রীলংকা। প্রায় ৩০ এভারেজ আর ৭৫ স্ট্রাইকরেটে ৬৬৬ রান। ২ টি সেঞ্চুরি আর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১২৭। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৩ ম্যাচে প্রায় ২৫ গড়ে আর ৬৭ স্ট্রাইকরেটে ৫৬৪ রান। কোনো সেঞ্চুরি নাই আর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৬৫। ভারতের সাথে ১৯ ম্যাচে প্রায় ৩৩ গড় আর ৮৫ স্ট্রাইকরেটে ৫৯৬ রান। সেঞ্চুরি নেই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ৭০। পাকিস্তান এর বিপক্ষে ১৭ ম্যাচে প্রায় ৪৩ গড়ে আর ৮৬ স্ট্রাইকরেটে ৬৮৪ রান। ২ টি সেঞ্চুরি আর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১৩২। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪ ম্যাচে প্রায় ৩৫ গড়ে আর ৮৯ স্ট্রাইকরেটে ৪৮৮ রান। ২ টি সেঞ্চুরি আর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১২৮ রান।

এছাড়া সাউথ আফ্রিকা,অস্ট্রেলিয়া,আয়ারল্যান্ডের সাথে দশের আশেপাশে ম্যাচ খেলেছেন। নিউজিল্যান্ড আর সাউথ আফ্রিকা বাদে বাকিদের সাথে গড় ৩৫-৪৫ এর মধ্যে। ইংল্যান্ড,পাকিস্তান,ওয়েস্ট ইন্ডিজ,ভারত এদের সাথে স্ট্যাট জিম্বাবুয়ের সাথে স্ট্যাট এর কাছাকাছি কিংবা ভালো। জিম্বাবুয়ের সাথে বেশি ম্যাচ খেলার দরুণ তাদের সাথে স্ট্যাট ভালো হবে এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। এখানে তামিমকে দোষারোপ এর কিছু নেই। তাই তামিম শুধু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই ভালো খেলে এটা যারা বলবে তারা ভুল তো বলছেই সাথে তামিমকে ডিসগ্রেস করছে এটাও বলা চলে।

এরপর চলুন একটু দেখি কোন দেশের মাটিতে তামিমের স্ট্যাট কেমন। খুব স্বাভাবিকভাবেই দেশের মাটিতেই তামিম সর্বোচ্চ ৯৮ টি ম্যাচ খেলেছেন। প্রায় ৩৯ এভারেজ আর ৮০ স্ট্রাইকরেটে ৩৫৭০ রান। সেঞ্চুরি ৭ টি আর সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত ১৫৮। দেশের বাইরে তামিম সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ২০ টি ম্যাচ খেলে প্রায় ৩৫ এভারেজ আর ৭২ স্ট্রাইকরেটে ৬৫৮ রান। সেঞ্চুরি ২ টি আর সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত সংগ্রহ ১৩০*। ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস আর জিম্বাবুয়ে দুই দেশেই তামিম ১৫ টি করে ম্যাচ খেলেছে। ইংল্যান্ডে প্রায় ৩৯ এভারেজ আর ৮১ স্ট্রাইকরেটে ৫৯০ রান। ১ টি সেঞ্চুরি আর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১২৮। জিম্বাবুয়ের মাটিতে ৩৭ এভারেজ আর ৭৮ স্ট্রাইকরেটে ৫৫৭ রান। ১ টি সেঞ্চুরি আর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১৫৪। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ১৪ ম্যাচে প্রায় ২৯ গড়ে আর ৭০ স্ট্রাইকরেটে ৪০৮ রান। কোনো সেঞ্চুরি নেই আর সর্বোচ্চ ৯৫। শ্রীলংকার মাটিতে প্রায় ৩৭ গড় আর ৮০ স্ট্রাইকরেটে ৪৩৯ রান। ২ টি সেঞ্চুরি আর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ১২৭।

অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড ছাড়া বাকি সব দেশেই তামিমের স্ট্যাট মোটামুটি ভালোই বলা চলে। তাই তামিম সুইং বা ময়েশ্চার উইকেটে ভালো করতে পারেনা এটা বলাটাও ভুল।

এরপর আমরা ইয়ার বাই ইয়ার তামিমের স্ট্যাটটা একটু দেখা যাক। এটা আমি বিস্তারিত বলতে চাচ্ছিনা। তবে এই জায়গায় তামিমকে আপনি দোষারোপ করতেই পারেন। যেখানে সাকিব,মুশফিকরা বছরের পর বছর নিজেদের এভারেজ আর স্ট্রাইকরেটকে উন্নত করছে আর নিজেদের আরো উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে সেখানে তামিমের উন্নতিটা খুব বেশি প্রশান্তিদায়ক না। ২০১৩-২০১৪ এর ভয়াবহ পারফরম্যান্স এর পর তামিম নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল নতুনভাবে।২০১৫ তামিমের স্বপ্নের মতই গেছে বলা চলে প্রায় ৪৭ এভারেজ আর ৮২ স্ট্রাইকরেটে ১৮ ইনিংসে ৭৪২ রান। এরপর এভারেজ বাড়লেও স্ট্রাইকরেটের দিক দিয়ে তামিম বার বার হতাশ করে গেছে। আধুনিক ক্রিকেটে যেখানে সবাই স্ট্রাইকরেটকে বাড়াচ্ছে সেখানে তামিম যেনো ঠিক উল্টো পথেই হাঁটছেন। ২০২০ এ এসে সেটার উন্নতি হলেও শুধুমাত্র জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে স্ট্যাট দিয়ে কিছু বলা যাবেনা।

তামিমের সমালোচনা আপনি করতেই পারেন। তবে সেটা অবশ্যই যুক্তির দ্বারা করতে হবে। আমি নিজেও মনে করি তামিম যদি গত দুই বছরের মত টুকটুক ক্রিকেট খেলে তো তার থেকে না খেলাই ভালো। তামিমের সবথেকে খারাপ দিক হলো স্ট্রাইক রোটেশনে তামিম তুলনামূলক দুর্বল। সাকিব মুশফিক বাউন্ডারি ছাড়াও যেখানে সাবলীলভাবে ইনিংস বড় করতে পারে সেখানে তামিম ডট বেশি খেলে চাপে পড়ে যায়। তামিমকে নিজেকে বোঝাতে হবে সে এখন অধিনায়ক এবং দলের ওপেনার৷ বড় ইনিংস খেলা যেমন জরুরি তেমনি নিজেকে ইমপ্রোভাইজ করাও জরুরি। ৮০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করে ১০০+ ইনিংস এর থেকে ১১০ স্ট্রাইকরেটে ৭০ রানও বেশি ইম্পর্ট্যান্ট এখন।

যাইহোক আমার এনালাইসিস এর মূল কারণ হচ্ছে এটা বলা যে তামিম জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কিংবা দেশের মাটিতেই শুধু ভালো খেলেনা। তামিম যখন ভালো খেলে সবার সাথে সবজায়গায়ই খেলে। আর যখন খারাপ খেলে তো সবার সাথে সবজায়গায়ই খেলে। তামিমের সমস্যা প্রতিপক্ষ,মাঠ কিংবা কন্ডিশন না। তামিমের সমস্যাটা মাইন্ডসেটে। তাই তামিমকে নিয়ে আলোচনা,সমালোচনা যাই করুন পয়েন্টে থেকে করুন। জিম্বাবুয়ের সাথে বেশি ম্যাচ খেলার কারণে শুধু তামিম না অনেকের স্ট্যাটই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তুলনামূলক ভালো। তাই এটা নিয়ে তামিমকে ক্রিটিসাইজ করতে গেলে পুরো দলকেই ক্রিটিসাইজ করতে হবে।

লিখেছেনঃ শাহরিয়ার শুভ্র