ক্রিকেট ইতিহাসে বাবা-ছেলের জুটির গল্প দুর্লভ কিছু নয়।
বিভিন্ন সময়ে ক্রিকেট বিশ্ব সাক্ষী হয়েছে বেশ কিছু বিখ্যাত বাবা-ছেলে জুটির, যারা নিজ নিজ সময়ে বাইশ গজে আলো ছড়িয়েছেন, মুগ্ধ করেছেন পৃথিবীকে, গর্বিত করেছেন নিজের পুত্রকে-গর্ব করেছেন নিজের পুত্রকে নিয়ে। বিশ্ব ক্রিকেটের প্রায় দেড়শ বছরের পরিক্রমায় আজ বিশ্ব বাবা দিবসে জেনে নেওয়া যাক তেমনই কিছু বিখ্যাত ক্রিকেটার বাবা-ছেলে জুটির গল্প।
ক্রিস ব্রড ও স্টুয়ার্ট ব্রড (ইংল্যান্ড)
১২৬ টেস্টে ৪৩৭ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের সর্বকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি স্টুয়ার্ট ব্রডের বাবা ক্রিস ব্রড। টেস্ট ক্রিকেটেই স্টুয়ার্ট ব্রডের চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন মাত্র সাতজন। রঙিন পোশাকেও মন্দ ছিলেন না। ওয়ানডেতে ১২১ ম্যাচে ১৭৮ আর টি-টোয়েন্টিতে ৫৬ ম্যাচে ৬৫ উইকেট নিয়েছেন স্টুয়ার্ট। স্টুয়ার্ট ব্রডের পূর্বসূরি ক্রিস ইংল্যান্ডের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন বহুবার। ২৫ টেস্টে প্রায় চল্লিশ গড়ে করেছেন ১৬৬১ রান।
ল্যান্স কেয়ার্নস ও ক্রিস কেয়ার্নস (নিউজিল্যান্ড)
কিউই ক্রিকেটের দুজন উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন কেয়ার্নস বাবা-ছেলে। বাবা-ছেলে দুজনই ছিলেন মিডিয়াম পেসার, প্রয়োজনে ব্যাট হাতেও ছিলেন সমান কার্যকরী। ১১ বছরের ক্যারিয়ারে নিউজিল্যান্ডের হয়ে ৪৩ টেস্টে ১৩০ উইকেট নিয়েছিলেন ল্যান্স কেয়ার্নস। এদিকে নিজের সময়ে ক্রিস কেয়ার্নস ছিলেন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। টেস্টে ৩০০০ রান ও ২০০ উইকেটের বিরল ‘ডাবল’ আছে ক্রিসের। ওয়ানডেতেও ছিলেন সমান কার্যকরী। ২০০ এর বেশি উইকেট আছে এই ফরম্যাটেও, সঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার রান। ৮৪.২৭ স্ট্রাইক রেটে ৪ সেঞ্চুরি ও ২৬ ফিফটির মালিক ক্রিসকে সমীহ করতেন বেশির ভাগ বোলাররাই।
সুনীল গাভাস্কার ও রোহান গাভাস্কার (ভারত)
ক্রিকেট ইতিহাস যেখানে সুনীল গাভাস্কারকে একনামে চেনে, সেখানে কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছেন রোহান গাভাস্কার। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের সর্বকালের সেরা ওপেনার সুনীল। দশহাজার রানের মাইলফলকেও প্রথম পৌঁছেছিলেন। টেস্টে ৩৪ সেঞ্চুরি ও ৪৫ ফিফটির মালিক সুনীল ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে। বাবার সাফল্যের ছিটেফোঁটা পাননি রোহান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আশা জাগালেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উপহার দিয়েছেন শুধুই হতাশা। তিনি ভারতের হয়ে সর্বসাকুল্যে খেলেছেন ১১টি ওয়ানডে।
লালা অমরনাথ ও মহিন্দর অমরনাথ (ভারত)
ভারতকে প্রথমবারের মতো বিশ্বজয়ের স্বাদ দেয়া মহিন্দর অমরনাথের বাবা লালা অমরনাথ। ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় বাবা-ছেলে জুটি এরাই। ১৭ বছরের দীর্ঘ টেস্ট ক্যারিয়ারে লালা ম্যাচ খেলেছিলেন মাত্র ২৪টি। ব্যাট হাতে ৮৭৮ রানের পাশাপাশি বল হাতে পেয়েছিলেন ৪৫ উইকেট। ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম শতক হাঁকানো ব্যাটসম্যান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানকে হিট আউট করা একমাত্র বোলারও লালা অমরনাথ। স্বাধীন ভারতের প্রথম টেস্ট অধিনায়কও লালা। দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়েও। ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে ম্যাচসেরা হওয়া মহিন্দর অমরনাথ ৬৯ টেস্টে সাড়ে বিয়াল্লিশ গড়ে এগারো শতকে করেছেন ৪৩৭৮ রান!
হানিফ মোহাম্মদ ও শোয়েব মোহাম্মদ (পাকিস্তান)
নিজ সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেটের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একজন ছিলেন হানিফ মোহাম্মদের পুত্র পাকিস্তানের অন্যতম ব্যাটিং নক্ষত্র শোয়েব মোহাম্মদ। ৫৫ টেস্ট ম্যাচে প্রায় ৪৪ গড় নিয়ে ৪০০০ এর কাছাকাছি রান করেছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে বার্বাডোজের ব্রিজটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩৩৭ রানের সেই মহাকাব্যিক ইনিংসটি টেস্ট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা সেঞ্চুরি হিসেবে পরিচিত। টেস্টে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের এটিই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর।
ছেলে শোয়েব ৪৫ টেস্টে সাত শতক আর ৪৪.৩০ গড়ে করেছিলেন ২৭০৫ রান।
রজার বিনি ও স্টুয়ার্ট বিনি ( ভারত)
১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের অন্যতম সদস্য রজার বিনির পুত্র স্টুয়ার্ট বিনি। বাবা রজার ১৯৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ ১৮ উইকেট সংগ্রহকারী ছিলেন।
স্টুয়ার্ট বিনি ভারতের হয়ে ওয়ানডে খেলেছেন।
পিটার পোলক ও শন পোলক (দক্ষিণ আফ্রিকা)
সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার শন পোলকের বাবা পিটার পোলক। নিজ নিজ সময়ে দুজনেই ছিলেন বিশ্বের সেরা পেসারদের মাঝে অন্যতম। মাত্র ২৮ ম্যাচের ছোট ক্যারিয়ারে ১১৬ উইকেট তুলে নিয়ে বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন পিটার পোলক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭৩৮৬ রান ও ৮২৯ উইকেট পাওয়া শনকে ক্রিকেটের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন বলেই মানা হয়। ওয়ানডেতে ৩৯৩ ওয়ানডে উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। টেস্টেও ৪২১ উইকেট নিয়ে ডেল স্টেইনের পর দেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বোলার শন পোলক।
বিজয় মঞ্জরেকার ও সঞ্জয় মঞ্জরেকার (ভারত)
বর্তমান সময়ের অন্যতম ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মঞ্জরেকারের বাবা বিজয় মঞ্জরেকার। বিজয় ভারতের হয়ে ৫৫ টেস্টে সাত শতক আর প্রায় চল্লিশ গড়ে করেছিলেন ৩২০৮ রান। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে উনি করেছেন বারহাজারেরও বেশি রান! ভারতের হয়ে ৩৭ টেস্টে ৩৭ গড়ে সঞ্জয় করেছিলেন ২০৪৩ রান, যেখানে চারটি শতকের পাশাপাশি ছিল একটি দ্বিশতক।
জিওফ মার্শ, শন মার্শ ও মিচেল মার্শ (অস্ট্রেলিয়া)
১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার কোচ জিওফ মার্শের পুত্র শন মার্শ ও মিচেল মার্শ। তিনজনেই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৫০ টেস্ট ও ১১৭ ওয়ানডে খেলেছিলেন জিওফ মার্শ। খেলোয়াড়ি জীবনে ইতি টানার পর কোচিংয়ে আসেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া শিরোপা জেতে তাঁর অধীনেই। মার্শ পরিবারের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভাব শন মার্শের। অভিষেকেই শতক হাঁকিয়ে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শন। কিন্তু সে সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। ছোট ভাই মিচেল মার্শও গায়ে চাপিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার জার্সি। বড় ভাইয়ের পরে অভিষেক হয়েও বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছেন মিচেল।
লেখকঃ আসিফ আফনান পিয়াল