লিওনেল মেসি- মানুষ নাকি ফুটবল ঈশ্বর?

0
8597

দিয়াগো সানাগ্রা ম্যারাডোনা! নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে দিয়াগো ম্যারাডোনার রক্তের কেউ! দিয়াগো ম্যারাডোনার নিজের রক্ত বইছে সানাগ্রার শরীরে! সিনিয়র ম্যারাডোনার মতো বোমা ফাটানোর অভ্যাস আছে জুনিয়র ম্যারাডোনারও! এইতো গত পরশু, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নাপোলির বিরুদ্ধে মরণ-বাঁচন ম্যাচে বার্সেলোনা মাঠে নামার চব্বিশ ঘন্টা আগে যা বললেন তাতে লিওনেল মেসির কপালে চিন্তার ভাঁজ সৃষ্টি করেছিল কিনা কে জানে।

জুনিয়র মারাদোনা বলেছিলেন, ”মেসি দারুন ফুটবলার। তবে ও মানুষ। ভুলবেন না আমার বাবা কিন্তু ঈশ্বর! তাই দুজনের মধ্যে কোনও তুলনা চলে না।”

নাপোলিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। আর সেই নাপোলির বিরুদ্ধেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ আটে ওঠার লড়াইয়ে গতরাতে মাঠে নেমেছিল মেসির বার্সা। হাইভোল্টেজ ম্যাচের ২৪ ঘণ্টা আগে জুনিয়র মারাদোনার কথাগুলো ছিল তাই যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। কেননা নাপোলির বিরুদ্ধে প্রথম লেগে মেসি ছিলেন নিষ্প্রভ। সেবার নাপোলির ঘরের মাঠে ১-১ গোলে ড্র করেছিল বার্সা। নাপোলি ম্যানেজার জেন্নারো গাত্তুসো প্রথম লেগে মেসিকে কার্যত বোতলবন্দি করে রেখেছিলেন!

তবে গাত্তুসে জুনিয়র ম্যারাডোনার মতো অত উদ্ধত নন! প্রথম লেগের আগে নিজের পা যথেষ্ট নিচেই রেখেছিলেন তিনি। সেবার ম্যাচের আগে সাংবাদিক সম্মেলনে উচ্ছ্বসিত গাত্তুসো জানিয়েছিলেন, ” সে যা করে শুধুমাত্র প্লে স্টেশনেই তা দেখা যায়। তার অবিশ্বাস্য গুণ রয়েছে। সে গত কয়েক বছর ধরে যা করেছে, তাতে সে সর্বকালের সেরা হয়ে গেছে।”

সেবার গাত্তুসোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, “লিওনেল মেসিকে আটকাতে কিছু ভেবেছেন কি না?” ইতালির বিশ্বজয়ী সাবেক এ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বলেছিলেন, ‘শুধু স্বপ্নেই সম্ভব। কিন্তু ছেলের প্লে স্টেশনে বার্সেলোনা বনাম নাপোলি ম্যাচে করতে পারি।’

নাপোলির ঘরের মাঠে হয়তো সেবার ছেলের প্লে স্টেশনের ম্যাচেই আটকেছিলেন, কিংবা স্বপ্নের সত্যি হয়েছিল! কিন্ত ন্যু-ক্যাম্পে গতরাতে সেই সুযোগ পাননি গাত্তুসো। না প্লে স্টেশন, না স্বপ্ন বরং বাস্তবের রক্ত-মাংসে গড়া মেসির মুখোমুখি হতে হয়েছিল নাপোলি কোচকে, বরং গত রাতে যে মেসি বনাম নাপোলির লড়াই হয়েছে এমনটা বললেও হয়তো ভুল বলা হবে না। ম্যাচের ফল নিশ্চয়ই এতক্ষণে জানা। মেসির গোলটাও নিশ্চয়ই ঘোরে বন্দি করেছে, চোখে লেগে আছে! তাই নয় কি? এটা কি জুনিয়র ম্যারাডোনার কথার জবাব দিলেন ফুটবলের ক্ষুদে জাদুকর? নাকি এটাই স্বাভাবিক? প্রশ্ন তো রয়েই যায়!

মেসি নিজেই এই মৌসুমে আগের মতো ভুড়িভুঁড়ি গোল করতে পারেন নি! আর এমন গোলের দেখাই তো মেলে হাজারে একটা! গতরাতে মেসি নিজে খেলেছেন দুর্দান্ত, বার্সাও উঠেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে। তবে গতরাতের ম্যাচের সেরা মুহুর্ত- নিশ্চয়ই ভূপাতিত জাদুকরের জাদুকরী ফিনিশিং! গোলটি দেখে মেসির তীব্রতর সমলোচকেরও মুখ ফুটে অস্ফুটে বেরিয়ে আসবে- ” অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয়!”
সেই গোলের পর গোল ডট কমের টুইট ছিল, ‘লিওনেল মেসি মানুষ না।’ এইতো আগের দিন জুনিয়র ম্যারাডোনা বললেন, মেসি মানুষ! তাহলে?
মেসি আসলেই মানুষ, তিনি ঈশ্বর কিংবা প্লে স্টেশনের ফুটবলার নন! তাই যদি হবেন, তাহলে কিচ্ছুক্ষন বাদেই ডি-বক্সের ভিতরে ফাউলের শিকার হয়ে কেন ব্যাথায় কাতরাবেন?

ম্যাচের বয়স তখন ২৩ মিনিট! লুই সুয়ারেজের বাতাসে ভাসানো ক্রস, উদ্দেশ্যে লিও মেসি। ঠিকমতো পায়ে নামিয়ে বা-পায়ে কাট করে দৌড় শুরু করেন নাপোলি বক্সের উদ্দেশে। তিন কাঠির থেকে বার্সা তারকা তখনো প্রায় ৪০ গজের মতো দূরত্বে। ডি-বক্সে ঢোকার সময় নাপোলির তিন ডিফেন্ডার তাকে ঘিরে ফেলেছিলেন। প্রথম ড্রিবলে পিছনে ফেললেন একজনকে, দ্বিতীয়বার এগোতে গিয়ে বাধা পড়ল সেই প্রথম ডিফেন্ডারের পায়েই! এবার ভাগ্য সহায়তায় দ্বিতীয় ডিফেন্ডারের পা ছুয়ে বলের গতিপথ বদলে আবারো আশ্রয় নিল মেসির পায়ে! তবে এবার বল সম্পূর্ণরূপে দখলে ব্যর্থ তিনি। বল পায়ে নিয়ে একবার পড়ে গেলেও ফের বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন এই আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। এরপর শরীরের ভারসাম্য যতক্ষণে হারালেন, তার মধ্যে সেই বিখ্যাত বাঁ পায়ে নিলেন কোণাকুণি শট । ফার পোস্ট দিয়ে ওসপিনাকে ফাঁকি দিয়ে বল পৌঁছায় জালে। বক্সের ভেতর মেসিকে শট নিতে না দিতে সামনে জটলা পাকান ডিফেন্ডাররা। গ্রিক ডিফেন্ডার কস্তাস মানোলাস চেস্টা করেছিলেন মেসির শট নেওয়ার কোনো সুযোগ না দিতে। কিন্তু তাঁর পায়ের পাশে ইঞ্চিখানেক ফাঁকা জায়গা দিয়েই শট নেন আর্জেন্টাইন তারকা। বাঁ পায়ের বাঁকানো নিখুঁত সেই শটের জাল ছোঁয়া ঠেকাতে পারেননি নাপোলি গোলরক্ষক ডেভিড ওসপিনা।

চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ ষোলোয় মেসির চেয়ে বেশি গোল আর কারও নেই। এ নিয়ে ২৭ গোল করলেন তিনি। ২৪ গোল নিয়ে দুইয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এ ছাড়াও ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ৩৫টি আলাদা দলের বিপক্ষে গোল করার বিশ্বরেকর্ড গড়লেন মেসি
চলতি আসরে এটি মেসির তৃতীয় গোল। নু ক্যাম্পে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিজের শেষ ছয় ম্যাচে ১২টি গোলে সরাসরি অবদান রেখেছেন বার্সা অধিনায়ক। রেকর্ড ছয়বারের ব্যালন ডি’অরজয়ী তারকা গোল করেছেন নয়টি, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও তিনটি।
আচ্ছা এভাবেও গোল করা যায়?