অবসর ভেঙে ফিরেছেন যারা

0
47238

“জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে?”

ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে আপনি যদি জীবনের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে বাইশ গজে আবির্ভাব হচ্ছে তার জন্ম, আর অবসর হচ্ছে তার মৃত্যু! মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমনি ক্যারিয়ার শুরু করলে সেই ক্যারিয়ারের ইতি যে টানতেই হবে তা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই কারো কাছেই, যেমনটা নেই জীবনে!

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় বলে দেন খেলাটার অন্যতম স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান মাইকেল ক্লার্ক! ক্লার্ক সর্বজয়ী কোন অধিনায়ক ছিলেন না, তবে একটা মিডিওকোর একটা দলকে সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় শিরোপা তিনিই জিতিয়েছেন। কেননা এলান বোর্ডারের দলের মতো সেরা কিংবা রিকি পন্টিংয়ের মতো সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দল তার ছিল না। তবুও ওয়ানডের সর্বোচ্চ সম্মানের ট্রফিটা অধিনায়ক হিসেবেই জিতলেন তিনি।

সেবার ২০১৫ তে, মর্যাদার অ্যাশেজ সিরিজ শুরুর আগেই অবসর নিলেন হ্যারিস, প্রথম টেস্টের পরই বাদ দিতে হয়েছিল ওয়াটসন-হ্যাডিনকে! লর্ডসের দাপুটে জয়ও হারিয়ে গিয়েছিল এজবাস্টন-ট্রেন্টব্রিজে! ৬০ রানেই অল-আউট হতে হলো, পরপর দুই টেস্টে দুইদিনেই হার চোখ রাঙ্গালো! আর ক্লার্ক যেন ভুলতে বসলেন তার সেই শৈল্পিক ব্যাটিং! শিল্প তো বাদই দিলাম, সাধারণ মানের ব্যাটিংও করতে পারেন নি তিনি। সর্বশেষ ১৩টেস্টে ছিল না সেঞ্চুরি, ৬টেস্টে ছিল না হাফ সেঞ্চুরি। ফলশ্রুতিতে ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ জেতাও হলো না তাঁর! মাইকেল জন ক্লার্ক তাই বিদায় বলে দিলেন। ওভালই শেষ। অধিনায়ক ক্লার্কের অধ্যায় শেষ, ক্রিকেটার ক্লার্কের অধ্যায় শেষ!
৩৮৯ নম্বর ব্যাগি গ্রিনের রূপকথার গল্প শেষ। ওভালে কোনো সেঞ্চুরি না পাওয়ায় তাই বাঁহাত ছুঁড়ে সেঞ্চুরি উদযাপনও শেষ! হয়তো ঠিক যেভাবে বিদায়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেভাবে হলো না। যেমনটা হয়েছিল ওয়ানডেতে, বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে!
অবসরে গিয়েও ক্রিকেটে ফিরে আসার নজির আছে। ক্রিকেটের বড় নামদের অনেকেই অবসরের ঘোষণা দিয়েও ফিরে এসেছেন আবার।
তাদের বেশিরভাগই দলের প্রয়োজনে। মাইকেল ক্লার্কও ফিরেছিলেন ক্রিকেটে । তবে ক্লার্ক ফিরছেন ক্রিকেটের টানে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কৈশোরের ক্লাব ওয়েস্টার্ন সাবার্বসের হয়ে মাঠে ফেরার ঘোষণা দিয়েছিলেন ক্লার্ক। সেই দলের হয়ে ক্রিকেটে ফিরেছিলেন ক্লার্ক। খেলেছিলেন বিগ ব্যাশেও, কিন্তু প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে মাত্র ৬রান করে আউট হন তিনি।
জীবন চরম অনিশ্চিত একটা মঞ্চ। জীবনের অংশ ক্রিকেট চরম এক অনিশ্চয়তার খেলা। জীবনে হরহামেশাই দেখা যায় আজকের রাজা কালকে বনে গেছেন ফকির, তেমনি বাইশ গজের লড়াইয়ে আজকে যে রাজা, কাল সে ফকির হবে না- এর কোনো নিশ্চয়তা নেই, দিতেও পারবে না কেউই! একদিন যে ক্রিকেটারের খেলা দেখার জন্য দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো কিংবা গাঁটের পয়সা খরচ করতো, যার ব্যাট থেকে আসা একেকটি চার বা ছক্কা অথবা যার প্রতিটি ইয়র্কারে উইকেট ছত্রখান হওয়ার দৃশ্য দেখে গ্যালারিতে দর্শকরা তীব্র উল্লাসে ফেটে পড়তো, সেই ক্রিকেটারই কোনো একদিন দর্শকের দুয়োধ্বনি শুনবেন না, সে কথা নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না কেউই! ক্রিকেট ইতিহাসে এমন অনেক ক্রিকেটারই আছেন, নিজেদের সময়ে যারা একাই বল কিংবা ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষকে একনিমেষেই হারিয়ে দিতেন। এসব তারকা ক্রিকেটারদের নিয়ে তাই দর্শকদের উচ্ছ্বাসও কম ছিল না।
ফলে অনেক সময় দেখা গেছে কোনো তারকা ক্রিকেটার অবসর নিয়েছেন বটে, কিন্তু দলের দুঃসময়ে ভক্তদের আকুল আবেদনে পুনরায় অবসর ভেঙে ফিরে এসেছেন। তাদের কেউ কেউ সফল হয়েছেন, আবার কারো কপালে জুটেছে ব্যর্থতার কালিমা। মাইকেল ক্লার্কও সফল হতে পারেন নি। আজ তেমনি কিছু তারকা ক্রিকেটারের গল্প শোনাবো, যারা অবসর থেকে ফিরে এসেছেন বটে, কিন্ত বাইশ গজে তাদের সফলতা ধরে রাখতে পারেন নি

“মার্টিন ক্রো”

নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাস তো বটেই, ক্রিকেট ইতিহাসে ‘মার্টিন ক্রো’ এক অবিস্মরণীয় নাম। ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ২৯৯ রানে আউট হন মার্টিন ক্রো!
১৯৯২ বিশ্বকাপের ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হন তিনি । নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকা করা হলে, তার নাম যে থাকবে শুরুর সারিতেই সে কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। ১৯৯৪ সালে ক্রিকেট থেকে বিদায়ের আগে ৭৭ টেস্টে ১৭ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৫,৪৪৪ রান আর ১৪৩ টি ওয়ানডেতে চারটি শতকসহ করেছেন ৪,৭০৪ রান। হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির কারণে ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন এই ক্রিকেটার। সবাইকে অবাক করে দিয়ে, অবসরের প্রায় ১৭ বছর পর ২০১১ সালে নিজের ৪৯ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ফেরার ঘোষণা দেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা সুখকর হয়নি তার এই প্রত্যাবর্তন। সেই ইনিংসে মাত্র তিন বল পর্যন্ত টিকেছিলেন তিনি।

“ওয়ালি হ্যামন্ড”

ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে একজন সফল অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন ওয়ালি হ্যামন্ড। ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন হ্যামন্ডের টেস্ট অভিষেক ঘটেছিল ১৯২৭ সালে। জোহানসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে সেই টেস্টে ব্যাট হাতে করেছিলেন ৫১ রান। কিন্তু বল হাতে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। তার ডানহাতি মিডিয়াম পেসে দক্ষিণ আফ্রিকার ৫ জন ব্যাটসম্যানকে ধরাশায়ী করেন মাত্র ৩৬ রানে। প্রথম শ্রেণিতে ব্রিটিশ হ্যামন্ডের এমনই কিছু রেকর্ড রয়েছে, যা বোধ করি কোনোদিনই কারো পক্ষে ভাঙা সম্ভব না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, বছরখানেক আগে তার গড়া ৭৩বছর আগের রেকর্ড ভাঙেন স্টিভ স্মিথ! জীবনে ৮৫টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫৮.৪৫ গড়ে ৭,২৪৯ রান করার পাশাপাশি ৮৩টি উইকেট লাভ করেছেন। ১৯৪৭ সালে অবসর নেয়ার প্রায় ৫ বছর পর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৫১ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ফিরে এসে গ্লুচেস্টারশায়ারের হয়ে খেলা ম্যাচে করেন মাত্র ৭ রান। সর্বকালের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ ইংলিশ ক্রিকেটার ওয়ালি হ্যামন্ডের অবসর থেকে ফেরার পর তার পারফরমেন্স ভক্তদের হতাশ করে। কেননা এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৩৩৬* রানের রেকর্ড ছিল একসময় তার দখলে!

“ফ্রেড ট্রুম্যান”

ইংল্যান্ড ক্রিকেট ফলো করেন আর তার নাম শুনেন নি, এটা অসম্ভব! ইংল্যান্ড ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা ফাস্ট বোলার হিসেবে যার নাম প্রথমেই যে কারো মাথায় আসবে, তিনি ফ্রেড ট্রুম্যান। টেস্টে প্রথম বোলার হিসেবে ৩০০ উইকেটের মাইলফলক অতিক্রম করনে এই বোলার। মাত্র ৬৭ টেস্ট খেলে নেন ৩০৭টি উইকেট, যা ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবে তার সক্ষমতার জানান দেয়। ১৯৬৮ সালে ট্রুম্যান বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করেন। কিন্তু ১৯৭২ সালে ৪১ বছর বয়সে আবার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ফিরে আসেন তিনি। কিন্তু খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তার সে যাত্রা। মাত্র ৭টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে ৬টি উইকেট নেন তিনি। সঙ্গে উপরি পাওনা ছিল ব্যাটসম্যানদের হাতের প্রচুর মার। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যতটা সফল, ফেরার পর ততটাই ব্যর্থ তিনি।

আগে যাদের উদাহরণ দিলাম সবাই ফিরেছেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে, এবার উদাহরণ হিসেবে থাকবেন তারা যারা ফিরেছিলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

“জর্জ হেডলি”

যুগ যুগ ধরে ওয়েস্টইন্ডিজ ক্রিকেট দেখেছে ব্যাটসম্যানদের রাজত্ব। সেই রাজত্ব যার হাত ধরে শুরু, তিনি জর্জ হ্যাডলি! তৎকালীন সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের একজন সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন জর্জ হেডলি। ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তাকে ধরা হতো প্রতিপক্ষের ত্রাস হিসেবে। ক্যারিয়ারে খেলেছেন মাত্র ২২ টেস্ট, তাতে ৬০.৮৩ গড়ে রান করেছেন ২,১৯০। ১৯২৯-৩০ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪ টেস্টের সিরিজে ৩টি সেঞ্চুরি এবং ১টি ডাবল সেঞ্চুরিসহ সব মিলিয়ে মোট ৭০৩ রান করেন। আর তখন থেকেই তার সতীর্থরা তাকে ডাকতে শুরু করেন ‘ব্ল্যাক ব্রাডম্যান’ নামে। ১৯৪৮ আলাই ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছিলেন একবার, অবসর নেয়ার ৬ বছর পর ১৯৫৪ সালে ৪৫ বছর বয়সে আবার জাতীয় দলের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন এই ক্যারিবীয়। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রত্যাবর্তনের সেই টেস্টে ইংল্যান্ডের বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার টনি লকের দুরন্ত ফ্লাইটের কাছে তাকে নতি স্বীকার করতে হয়। টনির বলে বোল্ড হওয়ার আগে করেছেন মাত্র ১৬ রান। সেটিই ছিল হেডলির শেষ টেস্ট।

“সনাৎ জয়াসুরিয়া”

আমরা বর্তমান প্রজন্ম ক্রিস গেইল কিংবা ম্যাককালামদের উইকেটে এসেই ধুন্ধুমার ব্যাটিং করতে দুখী। কিন্ত সর্বপ্রথম উইকেটে এসেই বোলারদের উপর স্টিমরোলার চালানো কোনো ব্যাটসম্যানের নাম জিজ্ঞেস করা হলে যে কেউ বলবে
সনাৎ জয়াসুরিয়ার নাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে করেছেন বিশ হাজারেরও বেশি রান, নিয়েছেন চারশোর বেশি উইকেট। ক্রিকেট ক্যারিয়ার থেকে অবসরের পর হঠাৎ করেই ৪১বছর বয়সে ঘোষণা দেন আবার ক্রিকেট মাঠে ফিরে আসবেন তিনি। তিনি তখন তার দেশের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ২০১১ সালে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে জয়াসুরিয়াকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ওয়ানডেতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু সে ম্যাচে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। ব্রেসনানের বলে মাত্র ২ রান করে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরে ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় জানান তিনি।

“এন্ডি কামিন্স”

১৯৯০ সালে ওয়ানডেতে অভিষেক ঘটে কামিন্সের! যদিও এর আগে ৫টি টেস্ট খেলছিলেন, তবে সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। ৭৬টি ওয়ানডে খেলে ৯১টি উইকেট শিকার করা কামিন্স ১৯৯৫-৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সর্বশেষ ওয়ানডে দলে সুযোগ পান, কিন্তু নিজেকে মেলে ধরতে না পারায় দল থেকে ছিটকে যান তিনি। এরপর নিজের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেন কানাডাকে। সেই কানাডার হয়ে আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখেন তিনি।২০০৭ বিশ্বকাপে ৪০ বছর বয়সে কানাডা জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পান। কিন্তু কানাডার হয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই করে দেখাতে পারেননি তিনি।

“ড্যানিয়েল ভেট্টোরি”

১৯৯৭ সালে ১৮বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় বাংলাদেশের স্পিন বোলিং কোচ ড্যানিয়েল ভেট্টোরির! টেস্ট ক্রিকেটের অন্তঃপ্রাণ ভেট্টোরি টেস্ট ক্যারিয়ার বাঁচাতে ২০১১ সালের জুনে সীমিত ওভারের ক্রিকেট ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি। তবে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অবসর ভেঙে ফেরেন সাবেক এই অধিনায়ক। ফিরেছিলেন ওয়ানডে দলেও, দলকে তুলেছিলেন বিশ্বকাপ ফাইনালেও! তবে প্রত্যাবর্তনের পর সেই পুরোনো ভেট্টোরির ছায়া হয়েই ছিলেন তিনি, নিজেকে নতুন করে চেনাতে পারেন নি তিনি।

সম্প্রতি গুঞ্জন উঠেছে অবসর ভেঙে ফিরছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স এবং যুবরাজ সিং। ভক্তদের চাওয়া থাকবে বাকিদের মতো তারা যেন হারিয়ে না যান, পুরোনো বেশেই ফিরুক তারা!